মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় প্রায় ২৫০ বিঘা সমতল ভ‚মিতে আগাম বর্ষাকালীন সবজি ঝিঙে চাষ করে লাভবান হচ্ছেন মোহাম্মদনগর এলাকার দুই শতাধিক সবজি চাষি। উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকা মোহাম্মদনগর এখন হয়ে উঠেছে ঝিঙের গ্রাম। গ্রামটির যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই ছড়িয়ে আছে ঝিঙে ক্ষেত। আঁকাবাঁকা রাস্তার দুইপাশে, বাড়ি ও টিলার ফাঁকের সমতলে সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঝুলছে হলদে ফুল। সবুজ পাতা আর হলদে ফুলের মাঝে জড়িয়ে আছে ঝিঙে।
ঝিঙে চাষ গ্রামবাসীর আত্মকর্মসংস্থানসহ অনেকের বাড়তি আয়ের উপায় হয়ে উঠেছে। এক সময়ের পাহাড়ি এলাকায় পতিত ছিল সমতল ওই ভ‚মি। সেখানে এখন বাণিজ্যিকভাবে ঝিঙের চাষ হচ্ছে। এতে এলাকার দুই শতাধিক কৃষক পরিবার আর্থিভাবে লাভবান হচ্ছে। এলাকায় কমেছে বেকারত্ব।
উপজেলা কৃষি বিভাগ ও চাষিদের সূত্রে জানা গেছে, মোহাম্মদনগর এলাকায় বহু বছর ধরেই ঝিঙে চাষ হচ্ছে। আগে কম চাষ হতো। প্রায় ২০ বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে ঝিঙে চাষ শুরু করেন এলাকার সবজি চাষিরা। এবার ২৫০ বিঘা জমিতে ঝিঙে চাষ হয়েছে। কম খরচে স্বল্প সময়ে ফলন অধিক হওয়ায় এখন এখানকার প্রায় ৮০ ভাগ পরিবার ঝিঙে চাষ করছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামটির যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই ছড়িয়ে আছে ঝিঙে ক্ষেত। কৃষকরা মাঠের পরিচর্যা করছেন। বিক্রয়ের জন্য ঝিঙে কাটছেন অনেকে। আবার কোথাও নতুন করে বীজ বা চারা রোপণ করা হচ্ছে। কৃষি কর্মকতারা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন। এ মুহ‚র্তে যেন দম ফেলার ফুরসৎ নেই চাষিদের।
ঝিঙে ক্ষেতে দেখা হয় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকতা রুহেল আহমদ ও নাবিল আহমদ খানের সাথে। তারা বলেন, পুষ্টিমানের দিক থেকে সবজি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বাণিজ্যিকভাবেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। সেজন্য সবজি চাষের আধুনিক কলাকৌশল জানা জরুরি। বড়লেখা উপজেলায় সবজি চাষের উর্বর জমি রয়েছে। ২০/২৫ বছর ধরে মোহাম্মদনগরে ঝিঙের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। কৃষকেরা সারা বছর অপেক্ষা করেন কখন ঝিঙে চাষ করবেন। আমরা স্থানীয়ভাবে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। সেচের সরঞ্জামাদি, প্রদর্শনী মাঠের কৃষকদের বিনামূল্যে সার ও বীজ দিয়ে থাকি। আমরা মাঠে এসে তাদেরকে সহযোগিতা করছি। ঝিঙে চাষে লাভ বেশি।
কৃষকরা জানান, বিজ রোপণের ৫০ থেকে ৫৫ দিন পর শুরু হয় ফসল তোলা। প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন মাস ফসল উৎপাদন করা যায়। আগাম তোলা ফসল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে। এখন ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সপ্তাহে তিন দিন বড়লেখার হাজিগঞ্জ বাজারে হাট বার। ওই দিনগুলোতে সকালবেলা চাষিরা ঝিঙে নিয়ে হাটে যান। সেখানে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারদের কাছে ঝিঙে বিক্রি করেন। কোনো কোনো পাইকার ক্ষেত থেকেও ফসল নিয়ে যান। এক বিঘা ক্ষেতে প্রায় ৫০ মণ ঝিঙে ফলে। প্রতি বিঘা জমিতে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ এবং ৯০ হাজার থেকে ১ লাখা টাকা আয় হয়। অন্যান্য ফসলের তুলনায় ঝিঙেতে রোগবালাইয়ের আক্রমণ কম এবং চাষ লাভজনক হওয়ায় ঝিঙে চাষে কৃষকদের আগ্রহ বেশি।
মোহাম্মদনগরের কৃষক ছৈয়ম উদ্দিন (৬০) বলেন, ঝিঙে চাষে খরচ কম আর লাভ বেশি। এবার দেড় বিঘা জমিতে ঝিঙে চাষ করেছি। বীজ, জমি তৈরি, কঞ্চি কেনাসহ বিভিন্নভাবে প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এ পর্যন্ত ৯০ হাজার টাকার ঝিঙে বিক্রি করেছি। আরও ৫০/৬০ হাজার টাকার ঝিঙে বিক্রির আশা করছি। গত বছর ১ লাখ ২০ হাজার টাকার ঝিঙে বিক্রি করেছিলাম।
একই গ্রামের কৃষক সেলিম উদ্দিন ও জাকির হোসেন বলেন, আগে অল্প জমিতে ঝিঙে চাষ করতাম। এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ করি। আমরা এবার ২ বিঘা করে ঝিঙে চাষ করেছি। প্রতি সপ্তাহে তিন দিন আমরা প্রায় ৩শ কেজি করে ঝিঙে বিক্রি করতে পারছি। আশা করছি বিঘাপ্রতি ১ লাখ টাকার বেশি লাভ হবে।
কৃষক নজরুল ইসলাম, মোদরিছ আলী, শাহিন আহমদ ও মাতাব উদ্দিন জানান, এই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ কৃষিনির্ভর। ঝিঙে চাষ করে কম-বেশি সবাই লাভবান হয়েছেন। ঝিঙেতে রোগবালাই কম হয়, তেমন কোনো সমস্যাও নেই। আগাম চাষের প্রথম দিকে পানির কিছুটা সংকট থাকে। স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ থেকে সহযোগিতা করা হয়। তাদের পরামর্শ নিয়ে পোকা-মাকড় দমনের জন্য কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। গত বছরের চেয়ে এবার বেশি জায়গায় ঝিঙে চাষ হয়েছে। ফলনও ভালো হয়েছে। ভালো দাম পাচ্ছি। আশা করছি গত বছরের চেয়ে এবার লাভ বেশি হবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকতা কৃষিবিদ মনোয়ার হোসেন বলেন, উপজেলাব্যাপী ব্যাপক ঝিঙে চাষ হয়। পাহাড়ি এলাকা মোহাম্মদনগর গ্রামসহ এবার প্রায় ৪০০ বিঘা জমিতে ঝিঙে চাষ হয়েছে। নব্বই দশকের শেষ দিক থেকে বাণিজ্যিকভাবে ঝিঙে চাষের প্রসার ঘটে এখানে। এখন প্রায় ৮০ ভাগ পরিবারই ঝিঙে চাষের সঙ্গে যুক্ত। চাষিরা জমি ফেলে রাখতেন। এখন সেই জমিতে ঝিঙে চাষ করে লাভবান তারা। বিঘাপ্রতি ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ কেজি ঝিঙে উৎপাদন হয়। উপজেলাব্যাপী কৃষকদের আয়ের প্রধান উৎস এখন সবজি চাষ।
দৈনিক ইনাতগঞ্জ বার্তা/ ইকবাল
Leave a Reply