যুগ যুগ ধরে দেশের অর্থনীতিতে চা শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে চা শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে কাজ করছেন চা-শ্রমিকরা। কষ্টের জীবন ও দরিদ্রতা যেন শ্রমিকদের নিত্যসঙ্গী। প্রতিবছর মে দিবস আসে, মে দিবস যায়। সারাদেশে ঘটা করে মহান মে দিবস পালিত হলেও চা-শ্রমিকদের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না। প্রতিবছর চায়ের উৎপাদন বাড়লেও চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে নেই তেমন কোনো পরিকল্পনা।
মৌলভীবাজার জেলার ৯২টি চা-বাগানে লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করছেন। প্রতিদিন ১৭৮ টাকা মজুরি দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। বাগানে কাজ করা অধিকাংশ নারী চা শ্রমিক হলেও কর্মক্ষেত্রে নেই তেমন কোনো নিরাপত্তা বা বাড়তি কোনো সুবিধা। চা-বাগানের মালিক কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি, রেশন ও স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য সকল সুবিধা দেয়া হচ্ছে।
বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বেতন-ভাতা প্রদান, রেশন বৃদ্ধি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ, চা শ্রমিক সন্তানদের চাকরি প্রদান ও স্থায়ীভাবে জমি বন্দোবস্তসহ নানা দাবি জানিয়েছেন চা শ্রমিকরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, সকালের কাঠফাটা রোদের মধ্যে চা শ্রমিকরা কাজ শুরু করেন। সকাল পেরিয়ে দুপুরের প্রখর রোদে ঘামে ভিজে সারা শরীর জবজবে। ভেজা জীর্ণ-শীর্ণ শরীরটা দেখলেই বোঝা যায় কেমন খাটুনি খাটতে হয় এই চা-শ্রমিকদের। তারা জানেন না মে দিবস কী।
শ্রমিকরা জানান, চা-বাগানের শ্রমিকরা সেই আগের মতোই নির্যাতিত ও অবহেলিত রয়েছেন। প্রতিবাদী হয়ে উঠলেই শ্রমিক তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেন বাগানের মালিকরা। ১৭৮ টাকা দৈনিক মজুরিতে সংসার চালাতে হয় তাঁদের। সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে পড়ালেখা খুব বেশি হয়ে ওঠে না তাদের ছেলে-মেয়েদের। নেই নিজস্ব নৃতাত্তি¡ক জাতিগত পরিচয়, নেই স্যানিটেশনও।
জানা যায়, বাংলাদেশে চা চাষের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ আর পুরাতন। ১৮৫৪ সালে সিলেটে যখন চায়ের বাগান করে চা উৎপাদন শুরু হয় তখন সিংহভাগের দখলে ছিল ব্রিটিশ বণিকরা। মাইলের পর মাইল বিশাল এই চা-বাগানে কাজ করার জন্য দরকার ছিল বিপুল শ্রমিক। বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশসহ ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিচু বর্ণের হিন্দু, ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর লোকজনকে কাজের প্রতিশ্রæতি দিয়ে চা-বাগান এলাকাগুলোতে নিয়ে আসা হয়। চা-বাগানের মাঝে ছোট মাটির ঘরে চা শ্রমিকদের বসবাস শুরু হয়। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে একটি কুঁড়ি আর দুটি পাতা ছিড়ে সৌখিন মানুষের কাপে চা পৌঁছে দিচ্ছেন শ্রমিকরা। মাঝে পেরিয়ে গেছে অনেক সময়। ভারত ভাগ হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু চা শ্রমিকদের ভাগ্য চা-বাগানের হাড়ভাঙা খাটুনির গÐিতে বাঁধা পড়ে আছে। বংশানুক্রমে সমাজের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন এই মানুষগুলোর নিজেদের ভ‚মির অধিকার নেই। ইংরেজ আমলে ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিয়ে আসা ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর এই শ্রমিকেরা মাইলের পর মাইল পাহাড়ি টিলা আর ঢাল পরিষ্কার করে চা-বাগানের সূত্রপাত করেছিলেন। বিনিময়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই মানুষেরা চা শ্রমিকের কাজটিই করে যাচ্ছেন। মোট চা শ্রমিকের প্রায় ৬৪ শতাংশই নারী এবং তাদের প্রায় সবাই খুব ছোটবেলা থেকেই চা-বাগানে কাজ করা শুরু করেছেন। প্রতিজন চা শ্রমিককে দিনে ২৩ কেজি চা পাতা তোলার লক্ষ্য দিয়ে দেওয়া হয়। বাগান বিশেষে এই লক্ষ্যটি ১৮ থেকে ২৪ কেজিতে ওঠানামা করে।
চা শ্রমিক নেতারা বলেন, মে দিবস আসে, মেয়ে দিবস যায়। তবু আমাদের শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো উন্নয়ন হয় না। মে দিবস এলেই যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, সেই সরকার আশার বাণী শোনায়। কিন্তু শ্রমিকদের ভাগ্য উন্নয়নে কেউ উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা রাখে না। আশা রাখি বর্তমান সরকার শ্রমিকদের ভাগ্য উন্নয়নে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেবে।
চা-শ্রমিক পরিবারের সন্তান রুবেল আহমদ বলেন, বাগানের শ্রমিকরা যে টাকা মজুরি পান সে টাকা দিয়ে লেখাপড়া তো দূরের কথা, ভালোভাবে দুইবেলা খাবারই জোটে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে বর্তমানে চা শ্রমিকরা সবচেয়ে অসহায় জীবনযাপন করছেন। আমাদের দুঃখ-দুর্দশা যেন দেখার কেউ নেই। সাধারণ শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করতে মালিকপক্ষ ও সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাই।
দিলকুশা চা-বাগানের সিনিয়র এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার কৃষিবিদ মো. বদরুল হুদা চৌধুরী বলেন, শ্রমিকরা হলেন চা-বাগানের প্রাণ। শ্রমিকরা ভালো থাকলে বাগান ভালো থাকবে। সরকারি বিধিবিধান অনুযায়ী চা-শ্রমিকদের যা প্রাপ্য তা মালিকপক্ষ বহন করছে। আমরা চা শ্রমিকদের মজুরি, বাসস্থান, রেশন, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাসহ সকল ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করতে কাজ করছি।
Leave a Reply